ইসলামের দৃষ্টিতে সুখী দাম্পত্য জীবন নিছক আবেগ বা ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি একটি সচেতন প্রচেষ্টা, যার ভিত্তি স্থাপিত হয় কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনার উপর। সুখী দাম্পত্য জীবনের মূল চাবিকাঠিগুলো হলো:
১. তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও একনিষ্ঠ নিয়ত:
এটিই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আল্লাহকে ভয় করে চলেন, তখন তারা একে অপরের প্রতি অন্যায় করা থেকে বিরত থাকেন। তাদের সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই তাকওয়াই যেকোনো ঝড়-ঝাপটায় তাদের সম্পর্ককে রক্ষা করে।
২. ভালোবাসা ও দয়া (المودة والرحمة):
এটি সুখী দাম্পত্যের প্রাণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১)
মায়া (মাত্তয়াদা): এটি হলো আকর্ষণ ও ভালোবাসার সেই অনুভূতি, যা একে অপরের প্রতি উষ্ণতা তৈরি করে।
দয়া (রাহমাহ): এটি হলো করুণা ও সহানুভূতি। যখন সঙ্গীর কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পায়, অসুস্থতা আসে বা ভালোবাসা কমে যায়, তখন এই দয়া সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে।
৩. পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান (Mutual Respect):
সুখী দাম্পত্যের জন্য একে অপরকে সম্মান করা অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে:
একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।
আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সামনে সঙ্গীকে সম্মান করা।
অপমানজনক বা বিদ্রূপাত্মক কথা না বলা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের সাথে সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসার সাথে আচরণ করতেন, যা আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
৪. ধৈর্য (সবর) ও ক্ষমা (Forgiveness):
কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। দাম্পত্য জীবনে ছোট-বড় ভুল বোঝাবুঝি বা সংঘাত হবেই। এক্ষেত্রে:
ধৈর্য: সঙ্গীর কোনো আচরণে কষ্ট পেলে ধৈর্য ধারণ করা এবং সুন্দরভাবে তাকে বোঝানো। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোনো মুমিন পুরুষ যেন কোনো মুমিন নারীর প্রতি বিদ্বেষ না রাখে। তার কোনো একটি অভ্যাস অপছন্দ হলে অন্য কোনো অভ্যাস নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।” (মুসলিম)
ক্ষমা: সঙ্গীর ভুলকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং তা মনে পুষে না রাখা একটি মহৎ গুণ, যা সম্পর্ককে বিষাক্ত হওয়া থেকে বাঁচায়।
৫. কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা করা (Shukr and Appreciation):
একে অপরের ছোট-বড় কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রশংসা করলে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
স্বামী যখন স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করেন বা ঘরের কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান, তখন স্ত্রীর মন ভালো হয়ে যায়।
স্ত্রী যখন স্বামীর পরিশ্রম ও চেষ্টার স্বীকৃতি দেন, তখন স্বামীর অনুপ্রেরণা বেড়ে যায়।
রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।” (আবু দাউদ)
৬. অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা:
ইসলাম স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্য কিছু অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। যেমন:
স্বামীর কর্তব্য: স্ত্রীর ভরণপোষণ, নিরাপত্তা ও উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
স্ত্রীর কর্তব্য: স্বামীর আনুগত্য করা (আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়া), তার সম্পদ ও সম্মানের হেফাজত করা এবং ঘরকে প্রশান্তির নীড় বানানো।
এই দায়িত্বগুলো বোঝা ও পালনের চেষ্টা করলে সংসারে ভারসাম্য আসে।
৭. একে অপরের পোশাকস্বরূপ হওয়া (Being a Garment for Each Other):
কুরআন স্বামী-স্ত্রীকে একে অপরের "পোশাক" (লিবাস) হিসেবে বর্ণনা করেছে।
“তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।” (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭)
পোশাকের কাজ হলো:
দোষ ঢেকে রাখা: স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দুর্বলতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করবে।
সুরক্ষা দেওয়া: তারা একে অপরকে বাইরের বিপদ ও গুনাহ থেকে রক্ষা করবে।
সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা: তারা একে অপরের জীবনে সৌন্দর্য ও পূর্ণতা নিয়ে আসবে।
৮. একসাথে ইবাদত করা:
একসাথে সালাত আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা এবং দ্বীনি আলোচনা করা সম্পর্কের মধ্যে আধ্যাত্মিক বন্ধন দৃঢ় করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সেই দম্পতির জন্য রহমতের দোয়া করেছেন, যারা রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং একে অপরকে জাগিয়ে দেয়।
সারসংক্ষেপ:
ইসলামের দৃষ্টিতে সুখী দাম্পত্য জীবন হলো একটি দলবদ্ধ প্রচেষ্টা (Teamwork), যেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, দয়া, শ্রদ্ধা, ধৈর্য ও ক্ষমার চর্চা করে এবং নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকে। এই চাবিকাঠিগুলো অনুসরণ করলে একটি পরিবার দুনিয়াতে প্রশান্তির নীড় এবং আখিরাতে জান্নাত লাভের মাধ্যম হতে পারে।