ইসলামে বিবাহকে শুধুমাত্র একটি সামাজিক বা জৈবিক প্রয়োজন হিসেবে দেখা হয় না, বরং এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বা উপাসনা হিসেবে গণ্য করা হয়। এর পেছনে বেশ কিছু গভীর আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কারণ রয়েছে। নিচে প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো:
১. আল্লাহর নির্দেশ পালন:
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার কথা বলেছেন এবং বিবাহের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
“এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১)
এই আয়াতে আল্লাহ বিবাহকে তাঁর একটি নিদর্শন (Ayah) বলেছেন এবং এর উদ্দেশ্য হিসেবে প্রশান্তি, ভালোবাসা ও দয়াকে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর এই বিধানকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ ও পালন করা একটি ইবাদত।
২. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ:
বিবাহ নবী-রাসূলগণের, বিশেষ করে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। তিনি নিজে বিবাহ করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে বিবাহ করার জন্য জোরালোভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন:
“বিবাহ আমার সুন্নাহ (রীতি)। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” (ইবনে মাজাহ)
রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করা একজন মুসলিমের জন্য ইবাদতের অংশ।
৩. ঈমানের পূর্ণতা দান করে:
ইসলামে বিবাহকে ঈমানের অর্ধেক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর কারণ হলো, বিবাহ মানুষকে অবৈধ যৌন সম্পর্ক, অশ্লীলতা এবং চারিত্রিক পদস্খলন থেকে রক্ষা করে, যা ঈমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“বান্দা যখন বিবাহ করে, তখন সে তার অর্ধেক দ্বীন (ঈমান) পূর্ণ করে। অতএব, বাকি অর্ধেকের জন্য তার আল্লাহকে ভয় করা উচিত।” (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান)
ঈমানকে পূর্ণ করার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃসন্দেহে একটি বড় ইবাদত।
৪. হারাম থেকে সুরক্ষা:
বিবাহ নারী-পুরুষকে ব্যভিচারের মতো কঠিন গুনাহ থেকে রক্ষা করে। মানুষের জৈবিক চাহিদা একটি স্বাভাবিক বিষয়। ইসলাম এই চাহিদাকে দমন না করে বিবাহের মাধ্যমে একটি পবিত্র ও বৈধ পথ দেখিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষভাবে যুবকদের উদ্দেশে বলেছেন:
“হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, তা চক্ষুকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে রক্ষা করে।” (বুখারী ও মুসলিম)
হারাম কাজ থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় একটি ইবাদত।
৫. পরিবার ও সমাজ গঠন:
বিবাহের মাধ্যমেই একটি ইসলামি পরিবার গঠিত হয়, যা একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজের মূল ভিত্তি। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এবং সন্তানের সঠিক প্রতিপালনের মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই সামাজিক দায়িত্ব পালন করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
৬. প্রতিটি কাজই সওয়াবের উৎস:
বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর প্রতিটি ভালো কাজই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়, যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। যেমন:
স্বামী তার স্ত্রীর জন্য যা খরচ করে, তা সদকা হিসেবে গণ্য হয়।
স্ত্রীর মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দেওয়াও সওয়াবের কাজ।
এমনকি স্বামী-স্ত্রীর বৈধ শারীরিক সম্পর্ককেও সদকা বা দান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা সাহাবীদের বিস্মিত করেছিল। রাসূল (সা.) তখন ব্যাখ্যা করেন যে, অবৈধ পথে তা করলে যেমন গুনাহ হয়, ঠিক তেমনি বৈধ পথে করলে সওয়াব হয়। (মুসলিম)
৭. নেক সন্তান লাভ:
বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ধার্মিক ও নেক সন্তান লাভ করা, যারা পরবর্তীতে পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করবে। একজন নেক সন্তান তার বাবা-মায়ের জন্য সাদাকাহ জারিয়াহ (চলমান সদকা) হিসেবে কাজ করে, যা তাদের মৃত্যুর পরেও সওয়াব পৌঁছাতে থাকে।
সারসংক্ষেপ:
ইসলামে বিবাহ নিছক একটি চুক্তি নয়, বরং এটি একটি পবিত্র বন্ধন এবং একটি ব্যাপক ইবাদত। এর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ পালন, রাসূলের (সা.) সুন্নাহর অনুসরণ, ঈমানের পূর্ণতা, গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা, এবং একটি صالح (ধার্মিক) সমাজ গঠনের মতো মহান উদ্দেশ্য সাধিত হয়। তাই নিয়ত যদি শুদ্ধ থাকে, তাহলে বিবাহের প্রতিটি মুহূর্তই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে।